গত বছরের মে মাসে ভাইরাল হওয়ার পর সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় আবার আলোচনা হচ্ছে যে, জেনারেল এ এ কে নিয়াজির নেতৃত্বে পাকিস্তান বাহিনীর বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যে ছবি তোলা হয় তা ভারতীয়রা এডিট করে প্রচার করছে। প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত থাকা তৎকালীন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকারকে ছবি থেকে ইচ্ছে করে বাদ দেওয়া হয়েছে নাকি অনিচ্ছাকৃতভাবে বাদ পড়েছেন?
মে’র ১৯ তারিখ মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান বীর উত্তম (Azizur Rahman Bir Uttam) তাঁর ফেসবুক ওয়ালে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের দুটি ছবিসহ একটি পোস্ট দেন। এর একটিতে এ কে খন্দকার আছেন, অন্যটিতে নেই। পোস্টে তিনি লিখেছেন, “১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে পাকিস্তান সেনা বাহিনী কর্তৃক যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনের এই ঐতিহাসিক ছবিটি সকলের কাছে সংরক্ষণের প্রয়োজন আছে যেখানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব দৃশ্যমান।
ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভাবে ভারতীয় প্রচার মাধ্যমে ছবির পিছনে দন্ডায়মান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এয়ার ভাইস মার্শাল (তখনকার গ্রুপ ক্যাপ্টেন) এ কে খন্দকারক বীর উত্তম কে ‘এডিট’ করে বাদ দেওয়া হয়ে থাকে। দ্বিতীয় ছবিটি দ্রষ্টব্য ।
আমাদের দেশেও জেনেই হউক বা না জেনে হউক অনেকে ঐ ‘এডিট’ করা ভারতীয় ছবিটি ব্যবহার করে থাকেন।“
তার এই স্ট্যাটাসের পর বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠে। এ কে খন্দকারকে ছবি থেকে এডিট করে বাদ দেয়ার অভিযোগ এনে অনেকে ভারতীয়দের কঠোর সমালোচনা করে। ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক মানুষ পোস্টে কমেন্ট এবং শেয়ার করেছে। বিষয়টি ভাইরাল হয়ে পড়ে। দেখা যায়, গত ৫ দিন অনেকে পোস্টটি নতুন করে শেয়ার করার পাশাপাশি সেখানে কমেন্ট করেছেন।
মূলত ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি, পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান জেনারেল ওসমানী আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। ফলে সে সময়ের উপ সেনাপ্রধান হিসেবে এ কে খন্দকার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের হয়ে উপস্থিত ছিলেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশের মিডিয়ায় আত্মসমর্পণ নিয়ে যেসব নিউজ হয়েছে সেগুলোতে এ কে খন্দকার অনেক ছবিতে আছেন, আবার অনেক ছবিতে নেই। ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে যে ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে সেটিতে তিনি কাটা পড়েছেন এবং নেই বললেই চলে। তবে ২০১৪ সালের একটি নিউজে ব্যবহৃত ছবিতে তাকে ভালভাবেই দেখা যাচ্ছে। দুই ধরনের ছবি ব্যবহার করেছে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারও।
অনেক পত্রিকা এবং ওয়েব সাইট সবাইকে বাদ দিয়ে শুধু অরোরা আর নিয়াজিকে ফোকাস করে ছবি ব্যবহার করে। এমনটি বেশী দেখা যায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে। যেমন, দি নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে প্রকাশিত সংবাদে শুধু আরোরা ও নিয়াজির ফটো ব্যবহার করা হয়েছে।
আবার দেখা যায়, অনেক ছবিতে অরোরা নিয়াজিসহ ভারতীয় অনেক অফিসার থাকলেও সেখানে এ কে খন্দকার নেই। এমনটি দুই দেশের গণমাধ্যমে ঘটেলেও ভারতীয়দের বেলায় এই প্রবণতা বেশী দেখা যায়। যদিও ভাইরাল হওয়া পোস্টে অনেকে মন্তব্য করছেন ভারতীয়রা ইচ্ছা করে এ কে খন্দকারকে এডিট করে ছবি থেকে বাদ দিয়েছে যেন ঐতিহাসিক এই ছবিতে বাংলাদেশের উপস্থিতির কোন প্রমাণ না থাকে।
Factখুঁজি বীর উত্তম আজিজুর রহমানের (যার ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়) সঙ্গে কথা বলে। তিনি জানান, “এডিট” বলতে তিনি বুঝিয়েছেন ইদানিং উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছবিতে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে বাদ দেয়ার একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে সেটাকে। যেহেতু পাক হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে ভারতীয় বাহিনী নয়; মিত্র বাহিনীর কাছে। স্বাক্ষরে সেভাবেই লেখা। তাই এরকম ঐতিহাসিক ছবি ব্যবহার ও শেয়ার করার ক্ষেত্রে অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে রেখেই ছবিটি সবার শেয়ার বা ব্যবহার করাট উচিত বলে তিনি মনে করেন।
এ বিষয়ে প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার ও চলচ্চিত্র পরিচালক শফিকুল ইসলাম, যিনি অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার দুর্লভ ছবি তুলেছেন, কিছুটা ভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দিয়ে Factখুঁজিকে বলেন, “অনেকটা সময় নিয়ে ছবিটি আমি দেখেছি। এটি এডিট করা নয়। অনুষ্ঠানের বিভিন্ন সময়ে একেকজন অবস্থান পরিবর্তন করতেই পারে। আবার একই অবস্থানে থাকলেও যারা ছবি তুলেছে তারা একেক জন একেক অ্যাঙ্গেল থেকে তুলতে পারে, তাই সব ছবিতে তিনি নাও থাকতে পারেন বলে আমি মনে করি।”
ভারতীয় কয়েকটি মিডিয়ার ছবিতে এ কে খন্দকারের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। আবার বাংলাদেশেও ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে তাকে রেখে বা বাদ দিয়ে সে সময়ের ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই শুধু ভারতীয়রা এডিট করে এ কে খন্দকারকে বাদ দিয়েছে বলে যে দাবি করা হয়েছে সেটা বিভ্রান্তিকর।