শুধুমাত্র নাম সর্বস্ব অনলাইন নিউজ পোর্টালের মাধ্যমে ফেইক নিউজ, গুজব অথবা বিভ্রান্তি ছড়ানো হয় না। বরং মূলধারার অনেক মিডিয়াও অনৈতিক এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর এই কাজে লিপ্ত। এক্ষেত্রে তারা দুভাবে ক্ষতি করছে। একদিকে নিজেরাই ভুয়া খবর, গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। অন্যদিকে নাম কথিত সব অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ফেসবুক আইডি ও পেজ মুল্ধারার মিডিয়ায় প্রকাশিত ভুয়া খবরের কপি করে অথবা লিঙ্ক দিয়ে তা আরও বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে দেয়। ফলে এসকল ভুয়া খবর বা গুজবকে পাঠক সত্যি মনে করে প্রতারিত হয়। কেননা, মুল্ধারার কোন সংবাদ মাধ্যমে কিছু প্রকাশিত হলে তার প্রতি মানুষের বিশ্বাস থাকে।
সম্প্রতি নওগাঁর একটি স্কুলে হিজাবের ঘটনাটি উদাহারণ হিসেবে দেখানো যেতে পারে।
দেখা যায়, ৬ এপ্রিল ২০২২ ফেসবুকে ছড়ানো হয় যে জাতীয় সঙ্গীত চলাকালে স্কুল ড্রেস পরে না আসায় শিক্ষিকা আমোদিনী পাল ছাত্রীদের মারধর ও গালিগালাজ করেন। পরিকল্পিত ভাবে কয়েকজন ছাত্রীর ভিডিও আর বক্তব্য দিয়ে অসত্য গল্প ছড়িয়ে দেয়া হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
সত্যতা যাচাই না করে কয়েকটি পরিচিত সংবাদমাধ্যম এ নিয়ে নিউজ প্রকাশ করে। এদের মধ্যে আছে যুগান্তর, বাংলানিউজ২৪ডটকম, দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক নয়াদিগন্ত এবং ঢাকাপোস্ট। এসব মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদের লিঙ্ক ও স্ক্রিনশট দিয়ে আরও অনেকে পোস্ট দিতে থাকে। বিশেষ করে ইসলামভিত্তিক কিছু আইডি আর পেজে শেয়ার হলে ভিত্তিহীন এই খবরকে সমাজের বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করতে শুরু করে। বিশেষ করে Ahmadullah নামের এক ফেসবুক আইডি সংবাদমাধ্যমের রেফারেন্স দিয়ে একটি পোস্ট দিলে তাতে প্রায় ১ লক্ষ মানুষ রিয়েক্ট করে, কমেন্ট করে হাজার হাজার।
পরবর্তীতে তদন্ত কমিটির তদন্তে বেরিয়ে আসে যে স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ আরও কয়েকজন পরিকল্পনা করে শিক্ষিকা আমোদিনী পালকে ফাসাতে চেয়েছিল আর সে কারণেরই পরিকল্পনা করে হিজাবের ঘটনা সাজিয়ে এমন গুজব ছড়ান হয়। এ নিয়ে আমোদিনী পাল মামলা করলে পুলিশ প্রধান শিক্ষককে আটক করে।
এভাবেই পরিচিত সংবাদমাধ্যমও ভুয়া খবর, বিভ্রান্তিরকর ও বিকৃত তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে।
Factখুঁজি মে ২০২০ এর থেকে বাংলাদেশে কারা ভুয়া খবর, গুজব আর বিভ্রান্তি ছড়ায় তা পর্যবেক্ষণ করে আসছে। দেখা গেছে, গত দুই বছর সময় টিভি, ইনকিলাব, ইত্তেফাক, জনকন্ঠ, একাত্তর টিভি, বাংলাদেশ প্রতিদিন, জাগো নিউজ, ডিবিসি, আমাদের সময়, আরটিভি ছাড়াও আরও অনেক মিডিয়া এর ধরনের কাজের সাথে জড়িত। প্রকৃতপক্ষে হাতে গোনা দু-তিনটি সংবাদমাধ্যম ব্যতিত অন্যান্য সব সংবাদমাধ্যমে কোন না কোন ভাবে মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ান হয়।
যেমন ২০২০ সালে ইত্তেফাক পত্রিকায় ইতালির প্রধানমন্ত্রীকে উধৃতি দিয়ে “একেকজন বাংলাদেশি একেকটা ভাইরাস বোমা” এই শিরোনামে একটি ভুয়া খবর অনলাইনে প্রকাশ হলে তা ব্যপকহারে ভাইরাল হয়। শত শত অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ফেসবুক ব্যবহারকারী শিরোনাম ও নিউজ ব্যবহার করে সারা দুনিয়ায় তা ছড়িয়ে দেয়। অথচ ইতালির প্রধানমন্ত্রী কখনোই এমন কথা বলেননি।
জুলাই ২০২০ সালে “এবার বিশ্বজুড়ে কোরবানি একইদিনে হতে পারে” এই শিরোনামে প্রকাশিত খবর অসংখ্য মানুষের মাঝে বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। ”হাসপাতালে বেড পাননি মাশরাফি” এমন ভুয়া খবরটিও ব্যাপক সাড়া জাগায় দেশে। এরকম দুটি সংবাদ প্রকাশ করে সময় নিউজ গুজব ছড়ায়।
সে বছরের আরেকটি ভুয়া খবর ছিল ফ্রান্সের তারকা ফুটবলার পল পগবাকে ঘিরে। অক্টোবরে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে যে ফরাসি এই ফুটবল ইসলাম নিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্টের মন্তব্যের প্রতিবাদে জাতীয় দল ত্যাগ করেছেন, যেটি ছিল নিছক এক গুজব ও অপপ্রচার। এটাকে রাবিশ উল্লেখ করে Pogba নিজেই তা অস্বিকার করেছেন।
মজার বিষয় হল বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদমাধ্যম পগবা ফ্রান্সের হয়ে আর খেলবেনা বলে খবর প্রকাশ করে। এদের মধ্যে আছে যুগান্তর, বাংলানিউজ টুয়েনটিফোরডটকম ও নয়া দিগন্ত।
বাংলাদেশে মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো কিভাবে ভুয়া খবর প্রকাশ করে তার আরেকটি উদাহরণ যেতে পারে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে এক মিছিল থেকে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর আটক হলে দেশের প্রায় সকল জাতীয় দৈনিক এবং টিভি চ্যানেল তাকে ধর্ষণ মামলায় আটক করা হয়েছে বলে প্রচার করে। অনেকে ব্রেকিং নিউজ করে। অথচ তাকে ধর্ষণের কোন মামলায় আটক করা হয়নি। পুলিশের কাজে বাধা প্রদানের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
অসুস্থ প্রতিযোগিতা, পেশাদারীত্তের অভাব ও নৈতিক অধঃপতনের কারনে এই প্রবণতা বেড়ে যায়।
গত বছরের অন্যতম ভুয়া খবর ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফুলব্রাইট স্কলারশিপ থেকে বাংলাদেশিরা বাদ আর তা প্রকাশ করে বাংলাদেশ প্রতিদিন, The Business Standard, বাংলানিউজ২৪। দাবি করা হয় বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে উক্ত স্কলারশিপ থেকে ২১-২২ শিক্ষাবর্ষে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বাদ দেওয়া হয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত ফেইক নিউজটি দ্রুতই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে আলোচনার ঝড় উঠে। এর ফলে
পরবর্তীতে পত্রিকাগুলো তাদের ভুয়া খবর অনলাইন থেকে সরিয়ে ফেলে। তবে এরই মাঝে ফ্যাকচেকিং প্রতিস্থান rumorscanner.com, factwatch.org ভুয়া খবরের স্ক্রিনশট ও তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমান করে দেয় যে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ থেকে বাংলাদেশিদের বাদ দেয়া হয়নি। এটি ভিত্তিহীন সংবাদ।
এধরনের ভুয়া খবর বা গুজব ছড়ানোর বিষয়টি বাংলাদেশে অহরহ ঘটছে। পরিতাপের বিষয় হল খোদ সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকরা এর সাথে জড়িত। নিজেরা ভুয়া খবর, গুজব ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং অন্যদের তা ছড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছে।
বাংলাদেশে মূলধারার মিডিয়া ভুয়া খবর, গুজব আর বিভ্রান্তি কেমন ছড়ায় তার একটা চিত্র বাংলাদেশ ফেসবুকের পার্টনার বুম বাংলাদেশ থেকে পাওয়া যায়। সাদের হিসেবে ২০২০ সালে যেসব মিডিয়া ভুয়া খবর, গুজব, বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেঃ
এছাড়া অন্তত ৩ টি করে ভুয়া খবর প্রকাশিত হয়েছে জাগো নিউজ ও নিউজ২৪, ঢাকা টাইমস-এ।
২ টি করে খবর প্রকাশিত হয়েছে আরটিভি, একুশে টিভি অনলাইন, ভোরের কাগজ, ডিবিসি, ডেইলি সান, নয়া দিগন্ত, সমকাল ও বাংলাদেশ জার্নালে।
আর ন্যুনতম ১ টি করে সংবাদ প্রকাশ করেছে বাংলা ট্রিবিউন, বণিক বার্তা, যমুনা টিভি, চ্যানেল আই-এ।
Factখুঁজি নিজস্ব সুত্র ছাড়াও আরও যেসব সুত্র হতে তথ্য নিয়েছেঃ
https://bangladesh.newschecker.co/en/fulbright-scholarship-hoax/
https://www.fact-watch.org/web/fullbright/
https://rumorscanner.com/fact-check/bangladeshi-are-excluded-from-fulbright-scholarship/8205
https://www.kalerkantho.com/online/miscellaneous/2021/12/14/1101337
https://www.prothomalo.com/bangladesh/district/%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%AC-%E0%A6%A8%E0%A7%9F-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%A1%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B8-%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A7%80%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%87%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8B-%E0%A6%B9%E0%A7%9F-%E0%A6%A4%E0%A6%A6%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4-%E0%A6%95%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A6%BF