নিউইয়র্ক ভিত্তিক সাপ্তাহিক ‘নিউজউইক’ এর দুইজন শীর্ষ সম্পাদক ও একজন প্রতিবেদককে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বরখাস্ত করা হয় মালিক-প্রতিষ্ঠান ‘দ্য নিউজউইক মিডিয়া গ্রুপ’ এর অর্থনৈতিক অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য। প্রতিবেদনে মালিকপক্ষের কয়েকটি অফিসে সরকার পরিচালিত অভিযানের খবর প্রকাশ করা হয়। নিউজউইক মিডিয়া গ্রুপের অর্থনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে চলমান অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে এই অভিযান পরিচালিত হয়।
সহকর্মীদের চাকুরিচ্যুতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন পত্রিকাটির সিনিয়র সাংবাদিক ম্যাথু কুপার ও রিপোর্টার ডেভিট সিরোটা। কুপার চাকুরিচ্যুতির ঘটনাটিকে ‘অপমানজনক’ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, তাঁর ত্রিশ বছরের সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে এতোটা ‘বেপরোয়া নেতৃত্ব’ তিনি কখনো দেখেননি।
নিউজউইকে সাংবাদিক বরখাস্তের ঘটনাটি ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ ও ‘দ্য ওয়াসিংটন পোস্ট’ সহ যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। নিউজউইকের পাশাপাশি আরো কিছু সংবাদমাধ্যম ঐ সময় ‘দ্য নিউজউইক মিডিয়া গ্রুপ’ এর মালিকানায় পরিচালিত হয়ে আসছিল।
চাকুরি হারানোর পর প্রতিবেদনটির রিপোর্টার কাটস এক টুইটার বার্তায় সম্পাদক ববকে সাহসী অ্যাখ্যা দিয়ে তার অন্যান্য সহকর্মীদের উষ্ণ অভিবাদন জানান মালিকপক্ষের অনিয়মের উপর প্রতিবেদন তৈরিতে তাকে সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য। মজার বিষয় হল, সাংবাদিকদের চাকুরিচ্যুতির পরেও সংবাদপত্রটি এর মালিক-প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সংশ্লিষ্ট ঐ প্রতিবেদনের শুরুতে পত্রিকাটি এ ব্যাপারে একটা ঘোষণা (নোট ফ্রম দ্য এডিটরস) প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, আমরা এমন সময় এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করছি যখন নিউজউইক মিডিয়া গ্রুপ তিন জন সাংবাদিককে তাদের কাজের জন্য চাকুরিচ্যুত করেছে। মালিকপক্ষের কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদনটিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। কোন ধরণের প্রভাব ছাড়াই লেখা ও সম্পাদনা করা হয়েছে।
মালিকপক্ষের অন্যায় ও অনিয়ম নিয়ে খবর প্রকাশ সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের জন্যই কঠিন ও অস্বস্তিকর। এমন নজিরও খুব বেশি একটা দেখা যায় না। নিউজউইকের একদল সাংবাদিক মালিকপক্ষের অনিয়মের খবর প্রকাশ করে যথেষ্ট সাহস দেখিয়েছেন যা স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য আশাব্যাঞ্জক। তবে এ জন্য তাদের চাকরি হারানোর ঘটনাটি দুঃখজনক এবং এটা স্বাধীন সাংবাদিকতা চর্চার জন্য বড় হুমকি।
সম্প্রতি রাজধানীর একটি থানায় মোসারাত জাহান মুনিয়া নামে এক নারীকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগে শীর্ষ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরকে অভিযুক্ত করা হয়। মুনিয়ার মৃত্যু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সৃষ্টি হয় ব্যাপক সমালোচনা। মূলত দুটি বিষয়ে নেটিজেনরা আহত হয়েছেন। এক, অভিযুক্ত আনভীরের নাম প্রথমসারির সাংবাদমাধ্যমগুলোতে শুরুতেই প্রকাশ না করা। দুই, নানান গল্প ও ছবি প্রকাশ করে ভিকটিম মুনিয়ার চরিত্র হরণের চেষ্টা। পাশাপাশি মুনিয়ার ব্যক্তিগত জীবনের নানা ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পরে যা সচেতন নাগরিকদের অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। নেটিজেনরা এ ধরণের কর্মকান্ডের সমালোচনায় সক্রিয় ছিলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। সংবাদমাধ্যম, সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করা হয় বিভিন্ন ধরণের ট্রল।
প্রশ্ন হল, দেশের প্রথমসারির সংবাদমাধ্যমগুলো কেন অভিযুক্ত আনভীরের নাম প্রকাশে কার্পন্য করেছে? এই বিলম্ব কি প্রাপ্ত তথ্য যাচাইবাছাই সংক্রান্ত সতর্কতার অংশ? নাকি অন্য কিছু?
অপরদিকে বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানায় পরিচালিত সংবাদমাধ্যমগুলো কেন এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি? ভয়টা আসলে কিসের? তাদের পাঠক-দর্শকসহ দেশবাসী কি শেষ পর্যন্ত অভিযুক্ত আনভীরের পরিচয় এবং ঘটনার সাথে তার সংস্লিস্থতার প্রকৃত কারণ জানতে পারেনি?
বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধিন পাঁচটি সংবাদমাধ্যমের মধ্যে চারটি সংবাদমাধ্যম–কালের কণ্ঠ, বাংলানিউজ২৪ডটকম, ডেইলী সান ও বাংলাদেশ প্রতিদিন–প্রায় একযুগ ধরে পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন দেশে সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকগুলোর একটি। দীর্ঘ সময় সাংবাদিকতা করলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর কেউ মুনিয়ার ‘আত্মহত্যা’র ঘটনার সাথে অভিযুক্ত আনভীরের নাম জড়িয়ে যাওয়া সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ করেনি কিংবা করতে পারেনি। কালেরকণ্ঠের অনলাইনে এসংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হলেও কিছুক্ষনের মধ্যে সরিয়ে ফেলা হয়।
এ প্রেক্ষিতে অনুমান করা যায় যে, বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমগুলোর উপর মালিক-প্রতিষ্ঠানের প্রভাব বেশ প্রবল। একই সাথে এটাও স্পষ্ট যে সেখানে কর্মরত সম্পাদক ও সংবাদ-ব্যবস্থাপকরা এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশে যথেষ্ট সাহস দেখাতে পারেননি, যা নিউজউইক করতে পেরেছে। সত্য প্রকাশে তাদের নির্লিপ্ততা সাংবাদিকতা পেশার মৌলিক নীতি বিরোধী এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার উপর এক ধরণের আঘাত।
মালিকপক্ষকে রক্ষা করা কিংবা মালিকপক্ষের অন্যায় ও অনিয়ম জনগনের সামনে তুলে না ধরতে পারার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য নতুন নয়। প্রথমসারির প্রায় সবগুলো সংবাদমাধ্যম এই চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর। পেশাদার সাংবাদিকরা এটা স্বীকার করেন এবং সচেতন পাঠকরা এ বিষয়ে কমবেশি জানে।
সংবাদমাধ্যমের উপর মালিকপক্ষের চাপ একটা বৈশ্বিক প্রবণতা। গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা মনে করেন সংবাদমাধ্যমে সেল্ফ-সেন্সরশিপ চর্চার প্রধান দুটি কারণের একটি হল সংবাদমাধ্যমের উপর মালিকপক্ষের অব্যাহত প্রভাব। এই মালিকপক্ষ যদি একই সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয় তবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ আরো বেশি সংকোচিত হয়।
বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমগুলো মুনিয়ার মৃত্যু সম্পর্কিত খবর প্রকাশ না করে দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক, পাঠক ও দর্শকের কাছে সংবাদমাধ্যমগুলোর গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বস্ততা কমেছে। দুই, প্রতিষ্ঠানগুলো সাংবাদিকতা পেশার মূলনীতির সাথে আপোস করে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের পেশাদারিত্ব ও আত্মবিশ্বাসে আঘাত করেছে যা তরুণ সাংবাদিকদের এ পেশায় প্রবেশে কিছুটা হলেও নিরুৎসাহিত করবে।
অপরদিকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যম অভিযুক্ত আনভীরের পরিচয় প্রকাশে বিলম্ব করায় সামগ্রিকভাবে এ পেশার প্রতি নাগরিকবৃন্দের এক ধরণের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। অন্যান্য সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের বিজ্ঞাপনের বাজার সুরক্ষা করতে এবং অভিযুক্তের প্রোফাইলের গুরুত্ব অনুধাবন করে তার নাম ও পরিচয় প্রকাশে সময়ক্ষেপণ করে। আশার কথা হল, বিলম্বে হলেও দেশের অন্যান্য সংবাদমাধ্যম অভিযুক্তের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করেছে। এখানে নেটিজেনরা সংবাদমাধ্যমের উপর এক ধরণের অদৃশ্য চাপ প্রয়োগ করেছেন।
২০১৮ সালে সংসদে সরকারের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু জানান, বাংলাদেশে মোট নিবন্ধিত পত্রিকার সংখ্যা ৩,০২৫টি। এদের মধ্যে দৈনিক পত্রিকার রয়েছে ১,১৯১টি। তিনি আরো জানান, সরকারের কাছে দেশে কতগুলো অনলাইন পত্রিকা রয়েছে তার হিসাব নেই। তবে, সেই সময় সরকারের কাছে অনলাইন পত্রিকার নিবন্ধনের জন্য আবেদন পড়েছিল ২০১৮টি। অপরদিকে, ডিজিটাল গবেষণা প্রতিষ্ঠান নেপোলিওনকাটের তথ্যানুযায়ী মার্চ ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় তিন কোটি ৮০ লাখ। এতো বিশাল সংখ্যার সংবাদমাধ্যম যে দেশে ক্রিয়াশীল সেখানে তথ্য লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা এক ধরণের অদূরদর্শীতা।
বাংলাদেশে সাংবাদিকদের মালিকপক্ষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ কম। এখানে সাংবাদিকদের সাহস প্রদর্শনের খুব বেশি অবকাশ নেই। দিন শেষে চাকুরি হারানোর এবং অর্থনৈতিক সংকটে পতিত হওয়ার ভয় অনেক সাংবাদিককেই এই পেশার নীতির সাথে আপোস করতে বাধ্য করে। এখানে সাংবাদিকদের জন্য নেই কোনো সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী। প্রতিবছর কিছু সাংবাদিক বিভিন্ন কারণে চাকুরি হারিয়ে বেকার হয়ে পরেন। চাকুরি হারানোর পর সাংবাদিকদের পেশাজীবী সংগঠনগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে খুব বেশি দেখা যায় না। নিয়মিত বেতন-ভাতা দেয় এমন সংবাদমাধ্যমের সংখ্যাও হাতে গোনা।
আবার, দেশে গণমাধ্যমের জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিজ্ঞাপনের বাজারের আকার সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত নেই। এখানে অনেক সংবাদমাধ্যম বিজ্ঞাপন সংগ্রহের জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করে। অনেকেই আবার বিজ্ঞাপন পেতে নানা ফন্দি-ফিকির করে। সরকারি বিজ্ঞাপন প্রকাশের পর তার অর্থ-মূল্য পেতে অপেক্ষা করতে হয় কয়েক বছর। সুতরাং, সংবাদমাধ্যম দেশের শীর্ষ একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি সম্পর্কে নেতিবাচক তথ্য প্রকাশে অতি-সতর্কতা নীতি অবলম্বন করবে কিংবা কালক্ষেপণ করবে সেটা অনুমেয়।
লেখকঃ শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।