২৬ এপ্রিল গুলশানের ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান মুনিয়ার লাশ উদ্ধারের পর থেকে একের পর এক বেরিয়ে আসছে কথোপকথন, ছবি, ভিডিও এবং স্ক্রিনশট। এসবের অধিকাংশই মুনিয়া এবং তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়া মামলার আসামী বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের। দ্রুত সেগুলো ছড়িয়ে পড়েছে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সাংবাদিক, সবাই সেগুলো শেয়ার করছেন। অনেক সংবাদমাধ্যমে এসব নিয়ে ফলাও করে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হচ্ছে।
ক’দিন আগে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের একটি কথোপকথন বেরিয়ে আসলো। অতীতে অনেকের কথোপকথন, ছবি এবং ভিডিও ফাঁস হতে দেখা গেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে এসব কথোপকথন, ছবি, স্ক্রিনশট বা ভিডিও ফুটেজের উৎস কি? কোথা থেকে কারা এগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে? তাদের উদ্দেশ্যই বা কি? এসব কি মুনিয়ার ব্যবহৃত ডিভাইস থেকে ছড়ানো হচ্ছে, নাকি আনভীরের? নাকি অন্য কোন সূত্র আছে? এসব নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছে না। অথচ বিষয়টি গুরুতর। শুধু তাই নয়, এর যে আইনগত দিকও আছে সেটাও আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি।
জানা গেছে, মুনিয়ার ব্যবহৃত দুটি ফোন ও একটি ল্যাপটপ জব্দ করা হয়েছে ঘটনার দিন সকালে। এর মধ্যে একটি Anroid ফোন আর অন্যটি iphone. এছাড়াও পুলিশ আরো অনেক কিছু ঐ ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করছে মামলার তদন্তের জন্যে।
মুনিয়ার ব্যবহৃত ডিভাইস ঘটনার তদন্ত ও আসামী শনাক্তের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। “ডিজিটাল আলামতের” ফরেন্সিকের মাধ্যমে অনেক কিছুই উদঘাটন করা সম্ভব। ফোন ও ল্যাপটপ ফরেন্সিক করে পৃথিবীতে অনেক বড় বড় ঘটনার সফল তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্ত করা গেছে। বাংলাদেশেও এর উদাহরণ আছে। যেমন- নারায়াণগঞ্জের সেভেন মার্ডার মামলা এবং চট্টগ্রামে এসপি বাবুল আকতারের স্ত্রী হত্যা মামলা।
এসব কারণে সারা বিশ্বে ডিজিটাল আলামত সতর্কতার সাথে সংরক্ষণ করা হয় যেন কোন তথ্য নষ্ট বা বেহাত না হয়। সঠিকভাবে সংরক্ষন বা ব্যবহার না করলে একদিকে যেমন আলামত নষ্ট হতে পারে, অন্যদিকে অশুভ উদ্দেশ্যে আলামত ব্যবহারের সম্ভাবনা থাকে। আবার ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে। মুনিয়া-আনভীরের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটছে বলে অনেকে সন্দেহ করছেন।
মুনিয়ার লাশ উদ্ধারের পর তার ব্যবহৃত ডিজিটাল আলামতগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা হেফাজতে নেয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে প্রথমে এগুলো হেফাজতে নেয় গুলশান থানার ওসি আনোয়ারুল হক। কয়েক দিন পর সেগুলো হস্তান্তর করা হয় সিআইডির কাছে ফরেন্সিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে সেখান থেকে গুরুতুপূর্ণ তথ্য বের করার জন্য।
মোবাইল, ল্যাপটপে যেসব তথ্য আছে:
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও ফরেসিক অনুসন্ধানে দক্ষ তানভীর হাসান জোহা মনে করেন, মুনিয়ার ব্যবহারকৃত ডিভাইস দিয়ে অনেক কিছুই প্রমাণ করা সম্ভব যদি সেগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। ভিকটিম তার ফোনে ও ল্যাপটপে যা যা করেছেন সব রেকর্ড সংরক্ষিত আছে। এর মধ্যে আছে কল রেকর্ড, কললগ, ছবি, ভিডিও, এসএমএস ও ভৌগলিক অবস্থান (geo-location)। ভিকটিম কার কার সাথে কথা বলেছে, কার সাথে কি ধরণের তথ্য আদান-প্রদান করেছে বিষয়গুলো সহজেই জানা সম্ভব। এগুলোর মাধ্যমে আসামি/আসামিদের সম্পর্কে অনেক তথ্য বের করে আনা সম্ভব।
নারায়াণগঞ্জের সেভেন মার্ডার ও চট্টগ্রামে এসপি বাবুল আকতারের স্ত্রী হত্যা মামলার তদন্তের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, “Electronic device অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য আসামীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধ প্রমাণে সাহায্য করেছিল।”
এ পর্যন্ত জোহা রাষ্ট্রীয় অনেক স্পর্শকাতর মামলায় আদালতে ডিজিটাল সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। তবে তিনি বলেন, “অনেক মামলা খারিজ হয়ে গেছে বা আসামীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমান করা সম্ভব হয়নি শুধুমাত্র ডিজিটাল আলামতসমূহ নষ্ট করা বা ঠিকমত সংরক্ষণ না করার ফলে।“
Digital Security Act -এর নীতিমালা অনুযায়ী, তদন্তাধীন মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট আসামী, বাদী বা ভিকটিমের কোন তথ্য প্রকাশ, প্রচার এবং শেয়ার করা যাবে না। এটা আইনত অপরাধ। এই আইনের ২৫, ২৬ ও ২৯ ধারা অনুযায়ী, অনুমতি ব্যতীত কারো ব্যক্তিগত স্পর্শকাতর তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। করলে এই আইনে সর্বাধিক ৮ বছর জেল এবং ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা হতে পারে।
তদন্তকালিন সময়ে কিভাবে মুনিয়া-আনভীরের ডিজিটাল আলামত ছড়াল, ডিজিটাল আলামত সংরক্ষণে কোন ধরনের অবহেলা বা এর অপব্যবহার হয়েছে কিনা, তা তদন্ত সাপেক্ষে খতিয়ে দেখা উচিত। অন্যথায়, ভবিষ্যতে এসব নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে এবং মামলার তদন্ত কিংবা বিচার প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে। তাই কর্তৃপক্ষের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ বলে তিনি মনে করেন তানভীর হাসান জোহা।
বিভ্রান্তি ও অপপ্রচারের সুযোগ:
মুনিয়া ও আনভীরকে জড়িয়ে যেসব তথ্য ফাঁস হচ্ছে এর সত্যতা কেউ নিশ্চিত করতে পারবেন না। কেননা, এগুলো ডিজিটাল ফরেন্সিক করার পূর্বেই ফাঁস হয়ে পড়ে। এখন ছবি ও ভিডিও এডিট করা সম্ভব। আর স্ক্রিনশট বানানো আরও সহজ। মোদ্দাকথা হচ্ছে, এসবের সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সত্যতা নিশ্চিত করে তা তদন্তে ব্যবহার করতে হবে, ফাঁস হতে থাকলে তা অনেক ধরণের সমস্যা তৈরি করতে পারে।
এদিকে ভাইরাল হওয়া কল রেকর্ডের ফরেনসিক পর্যালোচনার জন্য সোমবার স্বরাষ্ট্র সচিবকে একটি আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। ভাইরাল হওয়া অন্য সকল তথ্যও ফরেনসিক করা জরুরী বলে মনে করেন আইটি বিশ্লেষক জোহা।
তিনি বলেন, “এরই মধ্যে মুনিয়া আর আনভীরকে নিয়ে কিছু ভুয়া ডিজিটাল তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, যা মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।“